ছোটবেলায় নানি-দাদিদের কাছ থেকে অনেক রূপকথার গল্প শুনেছি। এমন একটা সময় ছিল যখন এসব গল্প তয় হয়ে শুনতাম আমরা। যেমন ডাইনি বুড়ির গল্প, ১২ হাত লম্বা চুলের রাজকুমারীর গল্প, রাক্ষস-খোক্ষসের গল্প, সাগরতলের রাজকন্যার গল্প ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সাগরতলের রাজকন্যার গল্পটি অনেকের মনেই রেখাপাত করে। গল্পটি ছিল এমন : একদা সাগরতলে ছিল এক রাজকন্যা। তার উপরের অর্ধেক ছিল মানুষের মতো আর বাকি অর্ধেক মাছের মতো। একসময় তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় মানব রাজপুত্রের। রাজকুমার মৎস্য কন্যাকে বলে, ‘যদি সে পূর্ণাঙ্গ মানুষে রূপ নিতে পারে তাহলে তাদের মধ্যে মিলন হওয়া সম্ভব।’ অনেক সাধনার পর মৎস্যকুমারী রূপান্তরিত হয় পূর্ণাঙ্গ মানুষে। কিন্তু এবার রাজপুত্র তাকে বিয়ে করতে অসম্মতি জানায়। এ দুঃখে মৎস্য কন্যারূপী রাজকন্যা নিজের প্রাণ বিসর্জন দেয়। না, এটি কোন বাস্তবের চিত্র নয়। বিখ্যাত লেখক হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসন তার দ্য লিটল মারমেইডের রূপকথার গাঁথুনী এরকম কাহিনী দিয়েই সাজিয়েছেন। তবে বাস্তবেও কি মৎস্য কন্যারা ছিল?
স্কটল্যান্ডের লোকমুখে প্রচলিত আছে, সেখানকার ইয়োলা দ্বীপের একজন পাদ্রির প্রেমে পড়ে এক মৎস্যকন্যা। পাদ্রির প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে মৎস্য কন্যা একসময় জানতে চায় কিভাবে সে আর অধিকারী হয়ে মানুষে রূপ নিতে পারবে। পাদ্রি জানায় যদি, সে চিরদিনের জন্য সাগর ছাড়তে পারে। যেহেতু তার জন্য এটা ছিল অসম্ভব, সেজন্য মৎস্য কন্যা চোখের জল ফেলে চলে যায়। তার চোখের জলগুলো আজও সেখানে নুড়ি হয়ে আছে।
১৪০০ শতাব্দীতে আফ্রিকার বেনিন অঞ্চলের রাজা ছিলেন চ্যান। তার রাজত্বকালে রাজ্যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে স্বেচ্ছায় মেরে ফেলা হতো। একসময় চ্যান আক্রান্ত হন প্যারালাইসিসে। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য তিনি ঘোষণা দেন যে রাজা চ্যান সাগর দেবতা হিসেবে পুনঃজš§ লাভ করে। তাই তার পা নেই। বয়সের ভারে চ্যান মারা গেলে তার সে রহস্য উচিত হয়ে যায়। যা এখনও ব্রিটিশ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। সমুদ্র বিজ্ঞানীদের মতে, এখনও সমুদ্রের অনেক কিছু তাদের কাছে অজানা। তাই মৎস্যকন্যার মতো কিছু থেকে থাকলেও বিচিত্র কিছু হবে না। ইতিহাসবিদদের মতে, সাগরকন্যাদের চুলে ছিল নানা রঙ। তবে তাতে শৈবাল রঙের প্রাধান্যই ছিল বেশি। এছাড়া তাদের ত্বক ছিল জলপাই রঙের, মুখের রঙ ধূসর, লম্বা লেজে ছিল গোলাপি কেশগুচ্ছ। কোমরে কমলার বন্ধনী এবং আঙ্গুলের ফাঁকে ছিল জলপাই রঙের জাল।
মৎস্যকন্যা সম্পর্কে উত্তর আয়ারল্যান্ডবাসী এখনও একটি গল্পকে সত্য মনে করে। সেটি ছিল ৫৫৮ সালের ঘটনা। তখন লিবানে হয়ে যাওয়া এক বন্যায় মারা যায় ছোট্ট একটি মেয়ের বাবা, মা। একসময় অভিমান করে সেও চলে যায় পার্শ্ববর্তী সাগরে। সেখানে ঢেউয়ের নিচে দিনের পর দিন থাকতে থাকতে সে রূপ নেয় মৎস্যকন্যায়। একদিন সে সাগরে গা এলিয়ে ভাসতে থাকলে কিছু জেলে তাকে তাদের জালে আটক করে। এর নতুন নাম দেয় মারজেন। বন্দি অবস্থায়ই সে মারা যায়। তাকে নিয়ে অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনারও সৃষ্টি হয়েছিল। রোমান লেখক ক্লিনি জানান, অগাস্টাস সিজারের একজন অফিসারে সাগরের অদূরে কয়েকটি মৎস্যকন্যাকে দেখেন। যাদের সবগুলো তখন ডাঙ্গায় আসায় আটকে গিয়ে করুণভাবে প্রাণ হারায়। অনেক আগে ব্যাবিলন এবং প্যালেস্টাইনের লোকেরা মৎস্যকন্যার পূজা করত। ফিনিশিয়ান ও কারিয়ানশিয়ানদের মুদ্রায় থাকত মৎস্যকন্যাদের ছবি। তখন রটেছিল যে, আলেকজান্ডার সাগরের নিচে মৎস্যকন্যাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন।
পশ্চিম ফ্রাইসল্যান্ডে ১৪০৩ সালে একটি মৎস্যকন্যা দেখা গিয়েছিল। যার সম্পর্কে ১৭০০ শতকের একজন ইতিহাসবিদ বিস্তারিত বলেন। তিনি জানান, তখন গ্রামের মানুষের সঙ্গে মৎস্যকন্যাটির ভাব হয়। যা টিকেছিল দীর্ঘ পনের বছর। এরপর সে মারা যায়। অর্ধেক মাছ অর্ধেক মানুষের মৃতদেহের প্রদর্শনী শিরোনামে লন্ডনের হলে একটি প্রদর্শনী ১৮৩০ সালে অনুষ্ঠিত হয়। দশ হাজার লিরার বিনিময়ে এ মৃতদেহটি খরিদ করে ইটালির দুই সহোদর। তবে একজন প্রকৃতিবিদ ওই মৃতদেহটি ভালোভাবে দেখে বলেন, এটি আসলে একটি বানরের মৃতদেহ, যার নিচের অংশে মাছের চামড়াকে সূক্ষ্ম সেলাইয়ের মাধ্যমে জোড়া লাগানো হয়। অবশ্য ১৯৬১ সালের দিকে একটি পর্যটন সংস্থা জীবিত অবস্থায় মৎস্যকন্যাকে নিয়ে আসতে পারলে পুরস্কৃত করা হবে বলে ঘোষণা দেয়। যা এখনও কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। গ্রিক পৌরাণিক কাহিনীতে উল্লেখ আছে, সমুদ্রে চলাচল করা নাবিকদের সম্মোহন করে সাগরের মৎস্যকন্যারা। তারপর তাদের মেরে ফেলে। এছাড়া অনেক স্থানে মৎস্যকন্যাদের ডাইনিদের সঙ্গেও তুলনা করা হয়। তবে বেশ পূর্বে ৫৯ ইঞ্চি লম্বা মৎসমানবরূপী একটি প্রাণী জালে ধরা হয়। বর্ণ দ্বীপে আটক করা প্রাণীটি ইঁদুরের মতো আওয়াজ করেছিল। কিছু না খেয়ে ১০৩ ঘণ্টা এটি বেঁচেছিল। প্রাণীটিকে ছোট মাছ খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কয়েকজন জেলে সম্প্রতি দাবি করেছেন, তারা মৎস্যকন্যার আদলে এবার মৎস্য নরের সন্ধান পেয়েছেন। তারা যখন কাসপিয়ান সাগরে মাছ ধরছিলেন, তখন এই মৎস্যনরটিকে দেখতে পান। মাছ ধরার ওই ট্রলারের ক্যাপ্টেন গাফার গ্যাসানভ ইরানি সংবাদপত্র ‘জিন্দেগি’কে বলেছেন, মাছ ধরার সময় তারা তাদের ট্রলারের পাশাপাশি অনেক সময় ধরে একটি মৎস্যনরকে সাঁতরাতে দেখেন। তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম দিকে আমরা একে একটি বড় মাছ বলে মনে করি। পরে একে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করতেই এর মাথায় কালো-সবুজ চুল দেখতে পাই। এর ডানাও ছিল বেশ অদ্ভুত ধরনের। তাছাড়া দেহের সুখভাগে হাতের মতো অঙ্গেরও দেখা পেয়েছি। প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা অনুযায়ী মৎস্যনরটি ছিল প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুটের মতো লম্বা।
Read more »