অত্যন্ত শান্ত ও নিরীহ গোছের দীর্ঘজীবী প্রাণী কচ্ছপ। কচ্ছপের শরীরের উপরিভাগের শক্ত খোলস আÍরক্ষার ঢাল হিসেবে কাজ করে। যখন শিকারি বা কোন প্রাণী একে আক্রমণ করে তখন এর চারটি পা ও মাথা ওই শক্ত খোলসের ভেতরে গুটিয়ে ফেলে। যার ফলে শিকারি ব্যর্থ হয়ে একে ছেড়ে দেয়। তবে এর চেয়ে কয়েকগুণ বড় ও হিংস্র শিকারি ছাড়া একে কেউ আক্রমণ করে না।
কচ্ছপ অবশ্য একটি উভচর প্রাণী। অধিকক্ষণ জলে থেকে ওরা আবার ডাঙায় উঠে আসে। উভয় স্থানেই কচ্ছপের খাবারের সুবিধা রয়েছে। যেমন পানিতে থাকলে এরা পানিতে থাকা সবুজ উদ্ভিদ, শ্যাওলা প্লাংটন, অনুজীব ইত্যাদি খেয়ে থাকে। আবার ডাঙায় এসেও নরম উদ্ভিদ এবং উপকূলীয় এলাকায় জন্মনো বিভিন্ন ফল এরা খাবার হিসেবে পেয়ে যায়। তবে সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এরা দীর্ঘজীবী প্রাণী। এর কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কচ্ছপের শরীরে রোগ-জীবাণুর পরিমাণ খুব কম। তবে কচ্ছপের দীর্ঘায়ুর আরও কিছু কারণ রয়েছে। আফ্রিকার উত্তর উপকূলে শিকারি জেলেদের কাছে মাঝে মাঝেই এমন অতিকায় কচ্ছপ ধরা পড়ে যারা প্রায় মাঝবয়সী অর্থাৎ যাদের বয়স একশ’র কোঠা পেরিয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যেখানে গাছ পাথরের জরা-মৃত্যু আছে, সেখানে একটি সচল প্রাণী কীভাবে এতদিন বেঁচে থাকে। কচ্ছপের দীর্ঘায়ু হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে ওর শরীরের বহির্গঠনকেই ধরা হতো। তবে রকমারি কচ্ছপ নিয়ে দীর্ঘকাল গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে শরীরের মজবুত বহির্গঠনের চেয়েও ওর প্রকৃতিই দীর্ঘায়ু হওয়ার প্রধান কারণ।
কচ্ছপ নিরামিষভোজী জীব তারপর প্রকৃতিগতভাবেই চলাফেরা কম করে বলে কাজের ব্যাপারে শক্তিও খুব অল্প ব্যয় হয়। এ ছাড়া সুদীর্ঘ বিশ্রামও ওর জীবনীশক্তি বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। বিশেষ দেহের গঠন অর্থাৎ হাড়ের পিঠ এবং মজবুত বক্ষদেশ কচ্ছপকে বাইরের প্রতিকূল আবহাওয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে। কচ্ছপের ফুসফুসও বেশ বড়। দেহের বাইরের আবরণ শক্ত এবং আঁটোসাঁটো হওয়ার দরুন কচ্ছপ কখনও ইচ্ছা করলেও ফুসফুস বেশি ফোলাতে পারে না। এমনকি কোন কোন জাতের কচ্ছপ ফুসফুসে যতটা হাওয়া ধরে তার চার ভাগের এক ভাগের বেশি হাওয়া নেয় না। ফলে একদিকে বেশি পরিশ্রমের শক্তি থাকে না এবং ফুসফুসের ক্ষয়ও হয় খুব ধীরে ধীরে।
কচ্ছপের প্রিয় ঋতু গ্রীষ্মকাল। অল্প রোদ কচ্ছপের বিশেষ প্রিয়। অল্প বৃষ্টিও কচ্ছপ পছন্দ করে কিন্তু বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি এড়িয়ে চলে। শীতকালটা কচ্ছপের পক্ষে খুব পীড়াদায়ক। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে এদের খুব একটা চোখে পড়ে না। সেই সময় এরা গর্ত খোঁজে। তৈরি গর্ত না পেলে নিজেরাই গর্ত খুঁড়ে নেয়। পাঁচ থেকে ১৫ কী ২০ ফুট পর্যন্ত গভীর গর্ত করে মাটির উত্তাপে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে। ঠাণ্ডা যদি বেশি পড়ে বা তুষারপাত হয় তখন খুব মুশকিল হয় কচ্ছপদের। গর্তের মুখে তুষার যে ঠাণ্ডা সৃষ্টি করে তা যদি খুব বেশি মাত্রায় গর্তের গভীরে প্রবেশ করে তাহলে অনেক সময় ঠাণ্ডার প্রকোপে কচ্ছপের মৃত্যু হয়। কচ্ছপ অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের প্রথমে গর্তে প্রবেশ করে এবং বের হয় এপ্রিলের প্রথম দিকে। এ পাঁচ মাস চলে টানা বিশ্রাম। প্রায় অসাড় অবস্থায় থাকার দরুন ওই সময় তার কোন খাদ্যের প্রয়োজন হয় না। এপ্রিলের গোড়ার দিকে কচ্ছপ যখন বেরিয়ে আসে গর্ত থেকে তখন সে থাকে চরম দুর্বল অবস্থায়। দুর্বলতা কাটাতে কচ্ছপের মাস দুয়েক সময় লাগে। অনেকটা যেন পুনর্জর মতো নতুন জীবনীশক্তি অর্জন করে। দীর্ঘকাল অনশন করেও কচ্ছপ বেঁচে থাকে। এর জন্য প্রকৃতিও তাকে সাহায্য করে। পাঁচ মাস অনশন শুরু হওয়ার একমাস আগে থেকেই কচ্ছপ খাওয়া কমিয়ে দেয়। প্রকৃতি প্রতিবছরই তাকে অনশনের জন্য এমন প্রস্তুত করে তোলে।
পৃথিবীর অনেক দেশেই কচ্ছপকে পোষ মানানো হয়। রীতিমতো যত আত্তি করে বাগানে রাখার সুবন্দোবস্ত করা হয়। আবার অনেকেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কচ্ছপের চাষ করে থাকে।
0 comments:
Post a Comment