আমরা আসছি অপেক্ষা করুণ---আমরা আসছি অপেক্ষা করুণ --- আমরা আসছি অপেক্ষা করুণ -

লালন তোমার আরশীনগর








লালনের কাছে চলো শাহিন ভাই মোবাইলে কল দিয়ে জানালেন। আমি বললাম কবে যাবেন? শাহিন ভাই বলল, গেলে এখনই যেতে হবে। বুঝতে পারলাম কয়েকদিন ধরে লালন স্মরণ মেলা হচ্ছে কুষ্টিয়ার ছেউরিয়ায়। শাহিন ভাই তার খবর দেখেছেন বোধহয়। আমাদের শাহিন ভাই খুব ব্যস্ত মানুষ। তার স্কুল আছে, কম্পিউটার সেন্টার আছে। কিন্তু ভ্রমণের কথা মনে উঠলে সব ফেলে ছুটে যায় রাঙ্গামাটি, জাফলং, কক্সবাজার। এমনি ভ্রমণাকুল জায়গায়। ভ্রমণ তার নেশা হয়ে গেছে। একবার আমি বললাম, শাহিন ভাই আগ্রার তাজমহল দেখে আসি। শাহিন ভাই বললেন, আগে দেশ দেখ। দেশের কোন সুন্দর জায়গার বর্ণনা পেলেই সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা এঁটে বসে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় লালনের আখড়ায় ভ্রমণ। যথারীতি শাহিন ভাই ভোরে আমার বাড়িতে এসে উপস্থিত। সঙ্গে আরেক প্রিয় মুখ আতিক আজিজ। আমাকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে চলল কুষ্টিয়ার উদ্দেশে। শনিবার দিন ১০ মার্চ। ভাগ্য ভালো আমাদের রাস্তায় জ্যাম পড়েনি। নইলে মিজমিজি থেকে যাত্রাবাড়ী যেতে এক ঘণ্টা লেগে যেত। সেখানে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে গাবতলী পৌঁছে গেলাম। দিনটা আমাদের অনুকূলে মনে হচ্ছে। বাসে সিট পেলাম মাঝামাঝি। বাস কাউন্টারগুলোতে কোন ভিড় নেই। রাজনৈতিক কোন বেপার-সেপার থাকতে পারে। টিকিট কেনার সময় কাউন্টার ম্যানেজার জানতে চাইল, কুষ্টিয়ার কোথায় যাবেন। বললাম, লালনের আখড়ায়। থাকব কি না জিজ্ঞেস করল? বললাম, না থাকবা না। আজই ফিরে আসব। ম্যানেজার পরামর্শ দিল আগামীকাল বাস বন্ধ থাকবে। তাই ওখানে নেমেই ফিরতি গাড়ির টিকিট কিনে নেবেন। কাউন্টারে বাস এলো সাড়ে ১০টায়। চড়ে বসলাম গাড়িতে, লালনের দেশের পানে। যেতে যেতে পথে আমার মুগ্ধ হওয়ার পালা। আগে একবার যমুনা ব্রিজ দিয়ে সিরাজগঞ্জ গিয়েছিলাম। আহামরি কিছু লাগেনি। সেবার খুব জ্যাম পড়েছিল। ৭ ঘণ্টা নিয়ে ছিল সিরাজগঞ্জ যেতে। এখন চলে এলাম ৩ ঘণ্টায়। মুগ্ধতা জেঁকে বসে আমার চোখে। এদিকের রাস্তাগুলো পরিষ্কার। একদম মসৃণ। আসল খেলাটা হল রাস্তার দু’পাশের দৃশ্য। তাকালে দেখতে পাই বিস্তৃণ আম ও লিচুর বাগান। পরিকল্পিত বাগানগুলো দেখতে ঠিক ছবির মতো। আম অথবা লিচুর গাছগুলো ছাতার মতো বসানো। তাতে মুকুল এসেছে মন ভরিয়ে। এ দৃশ্যগুলো যতই দেখি ততই মন পুলকিত হয়ে যায়। ইচ্ছা হচ্ছিল গাছগুলোর সঙ্গে ছবি তুলি। গাছগুলোকে ছুঁয়ে দেখি। বাগানের ছায়ায় গিয়ে কিছু ফ্রেস নিশ্বাস নেই। তা আর হল না। বাসওয়ালাকে বলতে বললও টাইম নাই। আমাদের আবেগ তাদের কাছে দু’আনার মূল্য পেল না। এ মনোরোম দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন পৌঁছে গেছি কুষ্টিয়া বাসস্ট্যান্ডে। নেমেই ঢাকা ফেরার টিকিট কিনে নিলাম। টিকিট না কিনলে সাংঘাতিক ঝামেলা হতো বুঝতে পারলাম। চললাম লালনের আখড়ায়। এখানকার বাহন হল রিকশা বা ব্যাটারিচালিত বেবি। বেবিওয়ালারা সুর করে ডাকতে থাকে এই লালন, লালন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম ভাড়া কত? বলল ১০ টাকা। দরাদরি করার সময় ছিল না। উঠে বসলাম বেবিতে। যাচ্ছে বেবি কবি আজিজুর রহমান সড়ক, বড় বাজার হয়ে তারপর লালন। চলে এলাম লালনের স্মরণ মেলা এলাকায়। ভেবেছিলাম। বিরাট আয়োজন। এসে দেখি সাদামাটা। ঘুরতে ঘুরতে গেলাম সাইজির মাজারে। ছোট একটা ঘরে সাইজি শায়িত। এখানে সাইজিকে ঘিরে বেশকিছু কবর আছে।
সাইজির ভক্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছে দেখা যায়। একজন ভারতীয়ের কবরও আছে এখানে। এ কবরগুলোর প্রতি বাউলদের ভক্তিশ্রদ্ধা আমাকে বিস্মিত করেছে। ভক্তিও প্রচণ্ড। এরা লালন সাইজীর কবর জেয়ারত করে পেছন হেঁটে ফেরেন। এখানকার খাদেম মোহাম্মদ আলী শাহ’র লালন স্টাইল চুল দাড়ি-গোঁফ। তার প্রতি ভক্তিও তাক লাগানোর মতো। মাজারের পর্ব শেষে গেলাম অডিটরিয়াম ভবনের দিকে। এটাই বাউলদের আসল জায়গা। বাউল-বাউলানীরা গোল হয়ে বসে, কেউ দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে হরদম গান গাইছে। দু’চার জন ফকিরি ঢংয়ে নেচেও যাচ্ছে। অন্য কোন গান নেই। শুধু লালনের গান। একাডেমির পাশের ভবন হল লালন মিউজিয়াম। দোতলায় লাইব্রেরি। মিউজিয়ামে তেমন কিছুই নেই। ভক্তদের ঘটিবাটি। সাইজীর ঘরের একটা দরজা ও তার বসার জলচকি সংরক্ষিত আছে। সাইজীর অনেক সাগরেদের আঁকা ছবি, কবি গুরুর ছবি, হাছন রাজার ছবিও মিউজিয়ামে আছে। মিউজিয়ামের প্রবেশ মূল্য ২ টাকা। এ টাকাটা কিসের জন্য বুঝা গেল না। মিউজিয়াম বলতে যা বুঝায় তার সিকি ভাগও নেই। ভেতরে ময়লা-আবর্জনায় ভরা। এখানে এসে জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিকের খুব প্রশংসা শুনলাম। আগে নাকি কিছু ছিল না। তিনি উদ্যোগ নিয়ে ভবনগুলো করেছেন। ধন্যবাদ তাকে। তবে তাকে এগুলোর প্রতি আরেকটু যত্নবান হতে বলব। তবেই যথাযর্থ সাইজীর ভক্ত হিসেবে তিনি পরিগণিত হবে। লালনের মাজারে ভ্রমণ করে একটা ব্যাপার নিশ্চিত হলাম এখানে মানুষ শিল্পী হয়ে যায়। এমন কাউকে পেলাম না। একবার হলেও গুনগুনিয়ে লালনের গান গাইছে না। যে দিকেই কান পাতি সেদিকেই শুনতে পাই সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়  মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষ সনে বাড়ির কাছে আরশিনগর, সেথায় এক পড়শি বসত করে  কে কথা কয়রে দেখা দেয় না, হাতের কাছে নড়ে চড়ে খুঁজলে জনম ভর মেলে না জাত গেল জাত গেল বলে, চাঁদের গায়ে দাগ লেগেছে আমার ভেবে করব কি?  এমনি অসংখ্য ভাববাদী গান বিরতিহীনভাবে কানে এসে প্রবেশ করে। আমি লক্ষ্য করলাম লালনের মাঝে একটা জাদু-মন্ত্রের ব্যাপার আছে। তার গানে যেমন আমরা ভস্মীভূত হইয়া আছি তেমনই সে তার আখড়ার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এখানে দর্শনীয় কিছু নেই। তারপর হাজার হাজার লোক ছুটে আসে। কিসের কারণে। আমার ধারণা এ লেখা পড়ার পর আপনিও লালনের আখড়ায় যাওয়ার তাগিদ অনুভব করবেন। কারণ কী? কারণ আর কিছু না। লালনের জাদু-মন্ত্র।


0 comments:

Post a Comment