নীলগিরি। নামটাই এত চমৎকার যে নাম শুনলেই জায়গাটাতে ঘুরে আসতে ইচ্ছা করে। বন্ধুদের কাছে নীলগিরির কথা অনেক শুনেছিলাম আর কবে নিজে যাব সেই আশায় প্রহর গুনতাম। হঠাৎ একদিন খালাত ভাই জানাল, তারা বান্দরবান যাচ্ছে। ব্যাস, সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম। বেরিয়ে পড়লাম চার দিনের ভ্রমণে। খালা-খালুর বান্দরবানে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য পাহাড়ে তামাকের পরিবর্তে হলুদ চাষ পর্যবেক্ষণ করা। কিন্তু আমার চিন্তা-চেতনা কেবল নীলগিরিকে নিয়েই ছিল। যা হোক, আমরা সকাল ৭টায় নিজেদের গাড়িতে রওনা দিলাম। ঢাকা থেকে বান্দরবান প্রায় ৩১৪ কিলোমিটার পথ। সময় লাগে ছয় ঘণ্টার মতো। আমরা পাঁচজন খালা, খালু, দুটি খালাত ভাইবোন ও আমি বিকালে নামলাম মিলনছড়ি রিসোর্টে। সেখানে আমাদের গাইড হলেন খালুর বিশ্বস্ত কর্মচারী জনাব জ্ঞান চাকমা। তিনি বান্দরবানের চাকমা সম্প্রদায়ের মানুষ। নেহাতই ভদ্র ও পরোপকারী লোক। তার থেকে জানতে পারলাম, স্থানীয় চালক ছাড়া নীলগিরিতে যাওয়া মোটেই উচিত নয়। নীলগিরিতে যেতে আড়াই ঘণ্টা লাগে। তাই তিনি একটি গাড়ি স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে ‘চান্দের গাড়ি’ সেটা ঠিক করে দিলেন। এমন ড্রাইভার নিলেন যিনি প্রায় প্রতিদিনই পর্যটক নিয়ে নীলগিরিতে যান। পর দিন সকাল ৭টায় খালু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আমাদের নিয়ে রওনা দিলেন নীলগিরির উদ্দেশে। চান্দের গাড়ি হচ্ছে আমাদের ঢাকার টেম্পো বা লেগুনার মতো। ভাড়া জনপ্রতি ৩০০ টাকা। যাত্রাপথের শুরুতেই পেলাম হাতিবান্ধা নামে ত্রিপুরা গ্রাম, গ্রামটির আদিবাসীরা খুবই চমৎকার। আঁকাবাঁকা পথ পেরোতেই চোখে পড়ল শৈলপ্রপাত ঝরনা (শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে), যার ঝমঝম শব্দ আগে থেকেই কানে বাজছিল। আমরা গাড়ি থামিয়ে নামলাম। জ্ঞান চাচার থেকে জানতে পারলাম সাংগু নদী ও এই শৈলপ্রপাত ঝরনা বান্দরবানের পানীয় চাহিদা মিটায়। চান্দের গাড়ি আবার ছাড়ল। শুরু হল রোমাঞ্চকর রাস্তা। একেবারে চড়ক গাছে যেন চড়েছি। গাড়ি কখনও খাড়া উপরে উঠছে তো কখনও নিচু ঢালে নামছে। তবে তার চেয়েও ভয়ের বিষয় যে রাস্তার বাঁক একটু ভুল করলেই খাড়া ৩০০ ফিট নিচে পড়ে যাব। খালু জ্ঞান চাচাকে স্থানীয় ড্রাইভার নেয়ার কারণে ধন্যবাদ দিলেন। পথে পড়ল পাহাড়ি উপজাতিদের গ্রাম বাওম, ফারুকপাড়া, মরুপাড়া। প্রায় এক ঘণ্টায় ১৪ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছলাম চিম্বুক। অপরূপ নয়নাভিরাম চিম্বুকে এসে আমরা যারপরনাই অভিভূত। চিম্বুক বাংলাদেশের উঁচু স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা এক হাজার ৫০০ ফিট উপরে। এখান থেকে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ পাহাড় দেখা যায় এমনকি দূরে বঙ্গোপসাগরও দেখা যায়। চিম্বুক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি চেকপোস্ট। পুরো পাহাড়ি এলাকা সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে। এখান দিয়েই নীলগিরি, থানচি, রুমা, বগালেক ও কেওকেরাডং যাওয়া হয়। চিম্বুক চেকপোস্টে আমরা সেনাবাহিনীকে গাড়ির নাম্বার ও তথ্যাদি দিয়ে আবার রওনা দিলাম। চিম্বুকের সবুজ পাহাড় দেখে আমার মনে বারবার প্রশ্ন জাগতে শুরু করল ‘নীলগিরি’ নাম কেন হল? ‘সবুজগিরি’ হওয়ার কথা। আমরা আরও দুই ঘণ্টা পথ পাড়ি দিলাম। একে বলে দুঃসাহসিক ভ্রমণ। এত ভয়ংকর ও উঁচু-নিচু পথ জীবনেও উপভোগ করিনি। আমরা সবাই রোমাঞ্চিত। অবশেষে আরও ৪২ কিলোমিটার পথ গাড়ি চালানোর পর পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্য স্বপ্নের নীলগিরি। নীলগিরি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দুই হাজার ২০০ ফিট উপরে এবং বান্দরবান টাউন থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে অনেকটা হতাশ হচ্ছিলাম। আমার খালাত বোন বলেই ফেলল, কোন জায়গায় এলাম, ঝড় হচ্ছে। আমরা পুরো ভিজে যাচ্ছি। কুয়াশায় কাউকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না। দৃশ্য দেখব কেমন করে!’ কথা শুনে জ্ঞান চাচা হাসলেন ও অপেক্ষা করতে বললেন। আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ চারদিক পরিষ্কার হয়ে গেল। একটু আগের ঝড় একেবারেই নেই। গায়ে ঝলমলে রোদ পড়ছে। আমরা প্রকৃতি দেখে বাকরুদ্ধ, বিমোহিত। মনে হচ্ছে রূপকথার রাজ্যের মেঘের দেশে এসে পড়েছি। আশপাশের পাহাড়ে সাদা মেঘ, হাতের কাছেই মেঘ উড়ে উড়ে যাচ্ছে। আমাদের নিচের পাহাড়ে মেঘ পাহাড়ের গায়ে বাড়ি খেয়ে সাদা চাদর হয়ে আছে। আর মেঘের ফাঁক গলে এসে মেঘের ওপর সোনালি রোদ চকমক করছে। আর আকাশের নীল রঙ এসে শুভ্র সাদা মেঘের সঙ্গে মিশে নীল একটা আভা তৈরি করছে যা পুরো পাহাড়ি এলাকাকেই নীল মেঘের দেশ বানিয়ে ফেলেছে।
এটাই হল নীলগিরি। জ্ঞান চাচা হেসে বললেন প্রথম এসেই আমরা কোন এক মেঘের ভেতরে ঢুকে পড়েছিলাম। আমরা অবাক। আমরা মেঘের ভেতরে ছিলাম এতক্ষণ! আশ্চর্য অনুভূতি লাগল গায়ে। আমার বোন ও ভাইয়ের মুখে মেঘ নিয়ে যত গান আছে সব গেয়ে চলছে। আমি শুধুই অভিভূত। ভাবছি বান্দরবান এসে যারা নীলগিরিতে না আসবে তারা কতটাই না বোকামি করবে। অপলক নয়নে বিধাতার প্রকৃতি নীলগিরি দেখছি আর গাইছি ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটিঃ আহা হা হা’। নীলগিরিতে রাতে অবস্থানের জন্য কটেজ তৈরি করেছে। ভিআইপি তিনটির প্রতি রাতযাপন তিন হাজার থেকে সাত হাজার ও ছোটগুলোর চার বেডের রুম দুই হাজার টাকার মতো। আরও কিছু রেস্টুরেন্ট আছে। আমরা সেখানে চুমাট কুরাহুরা নামক মারমা খাবার খেলাম যা হল বাঁশের গিটের ভেতরে মুরগি রান্না। সত্যি নীলগিরি যেন মেঘের দেশ।
0 comments:
Post a Comment